১৬ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার,সকাল ৯:০৫

একজন ব্যক্তি যখন রাজনৈতিক কর্মী ও সাংবাদিক হবেন, তখন সাংবাদিক পেশার মান কুলষিত হবে

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৪, ২০২৫

  • শেয়ার করুন

সাংবাদিকের বন্ধু থাকতে পারে না।কথাটিকে আক্ষরিক অর্থে নিলে অযথা বিতর্ক হতে পারে। এখানে আসলে বলা হয়েছে : ‘কারও প্রতি সাংবাদিকের দুর্বলতা থাকতে পারে না।

মোঃ হুমায়ুন কবির ঃ

একটা অভিযোগ অনেক দিন যাবৎ করা হচ্ছে যে, আমাদের সাংবাদিকদের একটা অংশ বড় দুই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। দেশের অন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পেশাও (সব নয়) রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। তবে অন্য পেশা রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হলে যত ক্ষতি হয়, গণমাধ্যম বিভক্ত হলে ক্ষতি হয় অনেক বেশি। অনেকে এই ক্ষতি জেনেশুনেও এসব বিভক্তির সঙ্গে যুক্ত হন। কারণ কোনো বড় দলের পক্ষপুটে থাকতে পারলে পেশায় যেমন দ্রুত ‘উন্নতি’ করা যায়, তেমনি আর্থিকভাবেও লাভবান হওয়া যায়। আজকাল বড় দুটি দলের যারাই ক্ষমতায় থাকে তাদের সমর্থক গোষ্ঠীর বাইরে প্রায় কোনো কিছুই তারা বিবেচনা করে না। বাংলাদেশে সরকারি কাজের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখন দলীয়করণ প্রতিষ্ঠিত সত্য। এটা নিয়ে কারও কোনো লজ্জা বা দুঃখবোধও নেই। উল্লেখ্য, গণমাধ্যম জগৎ তার বাইরে নয়।

এটা একটি পুরনো প্রসঙ্গের অবতারণা করছি ? এসব বিষয় এখন আলোচনা-সমালোচনার ঊর্ধ্বে। তবু প্রসঙ্গটির অবতারণা করছি শুধু একটি কারণে তা হলো, গণমাধ্যমের নেতারা আগে পরোক্ষভাবে দলবাজি করতেন। কিছুটা আড়াল করতেন। নিজেদের ‘দলীয় সমর্থক’ বলে পরিচয় দিতেন। অন্য দশটি পেশায় ‘দলীয় সমর্থক’ পরিচয় দেওয়া দোষের কিছু নয়। কিন্তু সাংবাদিকতা পেশায় ‘দলীয় সমর্থক’ পরিচয় দিতেও অনেকে দ্বিধান্বিত হন।

সাংবাদিকতা এমন এক পেশা যেখানে সব দল ও মতের প্রতি সমান গুরুত্ব দিতে হয়। এমনকি চরম সন্ত্রাসী, জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক শক্তিকেও গুরুত্ব দিতে হয় শুধু পেশাগত কারণে। তাদের বক্তব্য শুনতে হয়। অবিকৃতভাবে প্রকাশ বা প্রচার করতে হয়। মতামত দেওয়ার সময় সাংবাদিক তার মতামত স্বাধীনভাবে লিখতে পারেন। কোনো দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকলে বা বিরাগ থাকলে বস্তুনিষ্ঠ বা সৎ সাংবাদিকতা করা সম্ভব হয় না। হয়তো সে জন্যই সাংবাদিকতার আন্তর্জাতিক পণ্ডিতরা অনেক আগেই বলে গেছেন : সাংবাদিকের বন্ধু থাকতে পারে না।কথাটিকে আক্ষরিক অর্থে নিলে অযথা বিতর্ক হতে পারে। এখানে আসলে বলা হয়েছে : ‘কারও প্রতি সাংবাদিকের দুর্বলতা থাকতে পারে না।

যদিও বাংলাদেশের বর্তমান সাংবাদিকতা সম্পর্কে এসব নীতিকথা প্রযোজ্য নয়। ‘৯০-পরবর্তী সাংবাদিক সমাজ এ দেশের সাংবাদিকতা পেশাকে ভিন্ন একটি রূপ দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কাঠামো, চরিত্র বা নৈতিকতার সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। প্রবীণ সাংবাদিকদের অনেকেই বর্তমান সাংবাদিকতার অনেক নিয়ম-কানুন, ভঙ্গি, আচরণ মেনে নিতে পারেন না। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থেকে নানা সুবিধা নেওয়াও সেরকম একটি কাজ। বর্তমান প্রজন্মের অনেক পেশাদার সাংবাদিকও তা মেনে নিতে পারেন না। কিন্তু তারা অসহায়। কারণ অনেক পত্রিকা ও টিভির মালিকও বড় দুই দলের সঙ্গে যুক্ত। তারা মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের দলকে (দেশকে নয়) সেবা করতে চায়। কাজেই গণমাধ্যমের নীতিবান সাংবাদিকরা সত্যিই অসহায়। সুযোগসন্ধানী সাংবাদিকরা এই পরিস্থিতি নিজেদের স্বার্থে ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছেন। শোনা যায়, এরকম সুযোগসন্ধানী স্মার্ট সাংবাদিকদের অনেকেই ‘ম্যাডাম’ আর ‘আপার’ নাম ভাঙিয়ে বা প্রভাব কাজে লাগিয়ে অল্প বয়সেই বড় বড় পদ, বিপুল অর্থ ও সম্পত্তির অধিকারী হয়েছেন। প্রেসক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি বা গণমাধ্যম পাড়ায় তাদের কথা অনেকে আলোচনা করেন। তারা খুব অচেনা নন বা তারা কিছু গোপনও করেন না। গণমাধ্যম জগতে এগুলো এখন ওপেন সিক্রেট।

আজকের এ লেখার লক্ষ্য তাদের সমালোচনা করা নয়। তারা এখন সমালোচনার ঊর্ধ্বে। আমি বলতে চাচ্ছি, আগে এসব দলবাজি পরোক্ষ ভঙ্গিতে ছিল। এখন তা অনেকটা প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। তাতে এসব সাংবাদিক বিন্দুমাত্র বিব্রত বা লজ্জিত নন, বরং গর্বিত! তারা রাজনীতির মাধ্যমে দেশের জন্য কাজ করছেন! শুধু সাংবাদিকতা করলে তো দেশের জন্য কাজ করা হয় না!!

একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক তার প্রিয় রাজনৈতিক দলকে সহায়তা করতে চাইতেই পারেন। তবে তা পত্রিকা বা টিভির চাকরি বা দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে করাই উচিত। তার রাজনৈতিক দায়িত্ব যেন সাংবাদিকতার পেশাগত দায়িত্ব নিরপেক্ষভাবে পালনে কোনো বাধা হতে না পারে। বা রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন যেন পাঠক বা দর্শকের মধ্যে তার নিরপেক্ষতা সম্পর্কে কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে না পারে।

আওয়ামীলীগের আমলে  অনেক টিভি মিডিয়ায় ‘রাজনৈতিক টকশো’ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। পেশাদার সাংবাদিক এসব টকশোতে মডারেটরের দায়িত্ব পালন করছেন। দর্শকের ধারণা, এসব ক্ষেত্রে মডারেটররা হবেন দল-নিরপেক্ষ। আলোচকদের মতামত জানা ও সত্য অনুসন্ধানের জন্য মডারেটর চেষ্টা করেন। সেই মডারেটর যদি একটি রাজনৈতিক দলের মিডিয়া উপদেষ্টা হয়ে বসেন তাহলে তার নিরপেক্ষতা বা বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে আলোচক ও দর্শকের তো সন্দেহ জাগতেই পারে। অনেক টকশোর উপস্থাপক, তাদের বক্তব্য, প্রশ্ন ও দেহভাষার মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক আনুগত্য লুকানোর চেষ্টাও করেন নাই। বরং দলীয় পরিচয় নিয়ে তিনি যেন গর্বিত। হয়তো এর ফলে তার লাভও হচ্ছে।

কয়েকটি বৈষয়িক কারণে আজকাল সাংবাদিকদের মধ্যে দলবাজি করার প্রবণতা উৎকটভাবে বেড়ে গেছে। কারণগুলো হলো : . বিদেশি দূতাবাসে প্রেস মিনিস্টারের লোভনীয় চাকরি . সরকারি জমি পাওয়া . নামেবেনামে নানা ব্যবসায়িক সুযোগ পাওয়া . অধুনা টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স পাওয়া (যা পরে চড়া দামে বিক্রি করা যায়) . ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা নানা তদবির করে অর্থ উপার্জন . এমপি নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া . সরকারি মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে বড় পদ পাওয়া . প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব হওয়া . নিজের অযোগ্যতা সত্ত্বেও সরকার সরকারি দলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হওয়া ১০. নানা সরকারি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাওয়া ইত্যাদি (আরও কারণ থাকতে পারে) এসব পদ বা সুযোগসুবিধা পাওয়ার জন্য কোনো বিশেষ একাডেমিক বা পেশাগত যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। সাংবাদিকতা পেশায় থেকেও দলের সেবা করা নেত্রী সুনজরে থাকলেই এসব পদ সুবিধা পাওয়া যায়। অনেক সাংবাদিক বিভিন্ন উদ্দেশ্যে দলবাজি করে থাকেন। তবে কিছু সাংবাদিক দলীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিঃস্বার্থভাবেও দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ থাকেন। তাদের সংখ্যা খুব কম।

বিদেশি দূতাবাসে প্রেস মিনিস্টার পদে নিয়োগ পাওয়া এখন একেবারেই দলীয় আনুগত্যের ব্যাপার। তার যোগ্যতা বা দক্ষতা বিবেচনার বিষয় নয়। এ জন্য কোনো লোক দেখানো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাও হয় না। একজন সাংবাদিক দেশে প্রতি মাসে যা আয় করেন অন্তত তার ১০ গুণ টাকা বিদেশের চাকরিতে পান। তার চেয়েও বড় আকর্ষণ বিদেশে সপরিবারে থাকা। বিদেশের মাটিতে সরকারি খরচে গাড়ি, বাড়ি ফ্রি। একজন মধ্যবিত্ত সাংবাদিক জীবনে নিজের টাকায় কখনো বিদেশে যেতে পারেন না। এদের কাছে এটা তো রীতিমতো আলাদিনের চেরাগ দিয়ে স্বপ্ন পূরণ। সে দলবাজি করবে না তো কে করবে!

দলদাস সাংবাদিকরা আরও নানাভাবে উপকৃত হন। সব উপকার দেখা যায় না। তবে অনেক সাংবাদিক যে কোনো কোনো আমলে হঠাৎ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যান, তা অনেকের চোখকেই পীড়িত করে।

দুই বড় দলের সরকার নেতারা এর সুযোগ ভালোভাবেই গ্রহণ করছে। তারা কিছু সাংবাদিক পোষেন। এদের বলা যায়গৃহপালিত সাংবাদিক এরা মিডিয়ায় দল দুটির স্বার্থ রক্ষা করেন।

এই পটভূমিতে আমি একটা প্রশ্ন তুলতে চাই। তা হলো- এদের কি ‘সাংবাদিক বলা উচিত? এরা সাংবাদিক হলে দল-নিরপেক্ষ, স্বাধীন, নির্ভীক গণমাধ্যম কর্মীকে কী বলব? ওরাও সাংবাদিক? তাহলে পার্থক্য কী হলো? একটি গ্রুপ বড় দুটি দল থেকে নানা সুবিধা নিয়ে ‘সাংবাদিকতা’ করছে, আরেকটি গ্রুপ কোনো সুযোগ-সুবিধার তোয়াক্কা না করে নির্ভীকভাবে, কারও স্বার্থ রক্ষা না করে, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করছে। দুই গ্রুপকে কি একই সম্মান দেওয়া যায়? দেওয়া উচিত? পাঠকের কাছে আমার এই প্রশ্ন রইল।

সাংবাদিকতা পেশার কিছু শর্ত আছে। সাংবাদিক হতে হলে সেসব শর্ত মেনে চলতে হয়।

বিষয়গুলো নিয়ে আরও ভাবা দরকার। আমাদের দূষিত রাজনীতি অনেক পেশাকে প্রায় ধ্বংস করে এনেছে। সাংবাদিকতা পেশার ব্যাপারে আমরা এখনই সচেতন না হলে এই পেশার সম্মান ও ঐতিহ্য আমরা ধরে রাখতে পারব না। ইতোমধ্যে এ পেশার একটা বড় অংশ কলুষিত হয়ে পড়েছে। সবটা রাজনৈতিক কারণে হয়নি। কিছুটা অনৈতিকতা ও দুর্নীতির কারণেও হয়েছে। এটাও খুব উদ্বেগের বিষয় যে, সাংবাদিকতার পবিত্র অঙ্গনে দুর্নীতি ক্রমে ক্রমে ঢুকে পড়েছে। এটা সংবাদপত্র জগতে ওপেন সিক্রেট।

আমাদের সামনে এখন দুটি পথঃ ১) সাংবাদিকতা পেশায় রাজনৈতিক দলবাজি, দুর্নীতি, অনৈতিকতা ইত্যাদি বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া অথবা ২) এগুলো চোখ বুজে মেনে নেওয়া। চোখের সামনে সাংবাদিকতা পেশাকে কলুষিত হতে দেওয়া। আমরা কোন পথ বেছে নেব?

এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। আমাদের জাতীয় রাজনীতি, ছাত্ররাজনীতি, গণতন্ত্র, জাতীয় সংসদ, নির্বাচন, সরকারি প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি কি সবার চোখের সামনে আংশিকভাবে কলুষিত হয়ে যায়নি? আমরা কী করতে পেরেছি? সাংবাদিকতা পেশাকেও কি আমরা এভাবে কলুষিত হতে দেব? আপনার কী মত?

  • শেয়ার করুন