প্রকাশিত: অক্টোবর ১৬, ২০২৫
খুলনা নগর ঘিরে দিন দিন মানুষ বাড়লেও সিটি করপোরেশন এলাকা বাড়েনি ৩৩ বছরেও। এতে নগরের আশপাশে হচ্ছে অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠছে বড় বড় প্রতিষ্ঠান। এসব বিবেচনায় ১৪ বছর আগে সীমানা বর্ধিতকরণ প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও এখনও তা আলোর মুখ দেখেনি। ফলে শহর সীমানা সংলগ্ন এলাকায় নাগরিক সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত স্থানীয়রা।
২০২১ সালে মহানগরের আশপাশের মোট ১৮টি মৌজার ৪০.১০ বর্গকিলোমিটার এলাকা বর্ধিত করণের সংশোধিত প্রস্তাব পাঠানো হয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে, দীর্ঘ সময়েও তা আশার আলো দেখেনি।
নিজস্ব সংবাদদাতা ঃ
নদীবেষ্টিত নগরী খুলনা। এক পাশে ভৈরব, অন্য পাশে রূপসা এই দুই নদীর মাঝখানে লম্বালম্বিভাবে গড়ে উঠেছে নগরটি। ১৯৯০ সালে ৪৫ দশমিক ৬৫ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু ৩৩ বছর পার হলেও নগরের আয়তন আর এক ইঞ্চিও বাড়েনি। এই দীর্ঘ সময়ে জনসংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। নগরের বাইরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য আবাসন, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অথচ এসব এলাকা এখনো সিটি করপোরেশনের আওতার বাইরে থাকায় বঞ্চিত হচ্ছে নাগরিক সুবিধা থেকে।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব বাড়ার সাথে সাথে লোক সংখ্যা বাড়ায় এবং শহরের আশেপাশে জনবসতি ও স্থাপনা গড়ে ওঠায় ২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো নগরের দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশের ২০টি মৌজা কেসিসির অন্তর্ভুক্ত করতে প্রস্তাব পাঠানো হয়। সীমানা সম্প্রসারণে ২০১৪ সালে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের মতামত জানতে চায় জেলা প্রশাসন। বিভিন্ন আপত্তি শেষে ২০২১ সালে মহানগরের আশপাশের মোট ১৮টি মৌজার ৪০.১০ বর্গকিলোমিটার এলাকা বর্ধিত করণের সংশোধিত প্রস্তাব পাঠানো হয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। ওই প্রস্তাবনা সচিব কমিটির সভায় উত্থাপনের জন্য মন্ত্রী পরিষদ সচিবের কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু চার বছর পেরিয়ে গেলেও প্রস্তাবটি এখনও মন্ত্রণালয়ের টেবিলে।
প্রস্তাবিত বর্ধিত এলাকার মধ্যে রয়েছে মাথাভাঙ্গা, খোলাবাড়িয়া, হরিণটানা, ডুবি, আলুতলা, কৃষ্ণনগর, ঠিকরাবন্দ, চক মথুরাবাদ, আড়ংঘাটা, তেলিগাতি, যোগীপোল ও শ্যামগঞ্জ মৌজা। এছাড়া আংশিক অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রস্তাব আছে সাচিবুনিয়া, চক আসানখালি, বিল পাবলা, দেয়ানা, গিলাতলা ও আটরা মৌজার।
বর্ধিতকরণের খবর আসার পর থেকেই বর্তমান সীমানা সংলগ্ন এলাকাগুলোতে শুরু হয়েছে অপরিকল্পিত আবাসন নির্মাণের প্রবণতা। কিন্তু এসব এলাকায় নেই সুষ্ঠু ড্রেনেজ ব্যবস্থা, নেই রাস্তার লাইট, নেই ওয়াসার পানি সংযোগ। বর্ষায় সামান্য বৃষ্টিতেই তৈরি হয় জলাবদ্ধতা।
মাথাভাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা মো. সেলিম হোসেন বলেন, আমরা শহরের একদম পাশে থাকলেও কোনো নাগরিক সুবিধা পাই না। রাস্তায় লাইট নাই, ড্রেন নাই, সামান্য বৃষ্টি হলেই হাঁটুপানি জমে। ওয়াসার সংযোগের জন্য একাধিকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সিটি এলাকার বাইরে বলে দেয়নি।
জলমা এলাকার গৃহিণী রুবিনা খাতুন বলেন, ‘বছরের পর বছর শুনে আসছি আমাদের এলাকা সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু কবে হবে, কেউ জানে না। ভোটের আগে সবাই বলে কাজ হবে, কিন্তু পরে আর খবর থাকে না।’
তেলিগাতি এলাকার তরুণ ব্যবসায়ী আসিফুল ইসলাম রনি বলেন, ‘আমরা শহরের ঠিক পাশে থেকেও যেন গ্রামে বাস করি। নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হলে দ্রুত আমাদের এলাকাকে কেসিসির আওতায় আনতেই হবে।’
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, খুলনা এখন দেশের অন্যতম শিল্পনগরীতে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় অপরিকল্পিত নগরায়ন ভবিষ্যতে বড় ধরনের সংকট তৈরি করতে পারে।
খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবির উল জব্বার বলেন, নগর সম্প্রসারণ সময়ের দাবি। পরিকল্পিতভাবে নতুন এলাকা যুক্ত করতে না পারলে আগামী এক দশকের মধ্যে শহরটি তীব্র অবকাঠামোগত চাপের মুখে পড়বে।
বর্ধিতকরণ প্রক্রিয়ায় দ্রুত অগ্রগতি চায় কেসিসি কর্তৃপক্ষও।
খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শরীফ আসিফ রহমান বলেন, নিকার সভা অনুষ্ঠিত হলেই আমরা অনুমোদন পাব বলে আশা করছি। এরইমধ্যে বর্ধিত অংশের জন্য প্রাথমিক উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে।
প্রস্তাবনা অনুযায়ী, নতুন এলাকাগুলো যুক্ত হলে খুলনা সিটি করপোরেশনের মোট আয়তন দাঁড়াবে ৮৬ দশমিক ৭৫ বর্গকিলোমিটার, যা বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে খুলনা মহানগরে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ বাস করেন, আর বর্ধিত এলাকায় বাস করেন আরও ৬ লাখের বেশি মানুষ।
সিটি করপোরেশনের আওতায় এলে নতুন এলাকাগুলোতে রাস্তাঘাট, ড্রেনেজ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পানি সরবরাহের উন্নয়নসহ নাগরিক সেবায় আসবে গতি এমনটাই আশা স্থানীয়দের। ৩৩ বছরেও না বাড়া সীমানা যেন এখন উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। প্রশাসনিক অনুমোদনের অপেক্ষায় আটকে থাকা এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বদলে যেতে পারে খুলনা শহর ও আশপাশের লাখো মানুষের জীবনচিত্র।