প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০২৫

বিশেষ প্রতিবেদক ঃ
সারা দেশে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন গড়ে দেশে ১০ থেকে ১২টি হত্যাকাণ্ড ঘটছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী খুনের সংখ্যা প্রতিদিন দ্বিগুণ হারে বাড়ছে! এসব নৃশংস খুনের সঙ্গে মাদক জড়িত বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন।মাদকাসক্তরা নিজেকে নিজেই ভুলে যায়।মাদকই তাদের জীবনের আনন্দ বিনোদনসহ সব সুখ অপকর্মের সঙ্গী। মানুষের কাছ থেকে টাকা পয়সা ছিনতাই করার পর ,তাকে হত্যা করা বা ছুড়িকাঘাত, করার পরও তাদের অনুভব হয়না যে তারা অন্যায় করছে। দেখা যায় তারা তাদের আস্তানায় বসে মদ, নেসা পান করছে আর আনন্দের সাগরে ভাসছে। সংবাদপত্রে ও চ্যানেলে বিভিন্ন সময় এমন ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক শ্রেণির শিক্ষার্থী গ্রুপ করে মোবাইলে খারাপ পর্নো দেখছে। এতে তারা উত্তেজিত হয়ে নানান ধরনের নেসায় আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে বড় একটি অংশ আবার ইয়াবায় আসক্ত। লেখাপড়া বাদ দিয়ে তারা বিপথগামী হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করে পেয়েছেন বেশ কিছু তরুণ-তরুনিরা গ্রুপ করে ইয়াবা সেবন করছে। একপর্যায়ে তারা নৃশংসতায় জড়িয়ে পড়ছে।
সম্প্রতি রংপুর থেকে ব্যবসায়ী আশরাফুলকে তার বন্ধু জরেজ মিয়া শনিরআখড়ায় বান্ধবীর বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে বান্ধবীসহ মিলে জরেজ মিয়া আশরাফুলকে হত্যা করে। এরপর লাশ ২৬ টুকরা করে ড্রামে ভর্তি করে হাইকোর্ট এলাকায় ফেলে যায়। এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জরেজ মিয়া তার বান্ধবীর সঙ্গে যৌনকর্ম করেছেন বলে স্বীকারোক্তিতে বলেছেন। চাঁদপুর জেলায় কচুয়া উপজেলায় বাইছাড়া গ্রামে গত ২২ নভেম্বর পারিবারিক বিষয় নিয়ে বাবা-ছেলের মধ্যে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে আব্দুল খালেককে তার ছেলে মোহাম্মদ হোসাইন প্রকাশ্যে দা দিয়ে কুপিয়ে দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
সম্প্রতি খুলনা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান ফটকের সামনে হাসিব ও রাজন নামে দুই যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিহত দুই জন এই এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী মাদক ব্যবসায়ী পলাশ গ্রুপের সদস্য। মাদক ব্যবসায়ে বিরোধ নিয়ে তাদের হত্যা করা হয় বলে প্রতক্ষদর্শিরা জানিয়েছেন। এদিকে খোদ রাজধানী মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে প্রায় রাতেই মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বোমাবাজি ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী বুনিয়া সোহেলকে সেনাবাহিনী আটক করেছে।
প্রতিদিনই সারা দেশে এই ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের নৃশংসতার সঙ্গে মাদকাসক্তরা জড়িত। কারণ তারা কাদের হত্যা করছে, এই চেতনাবোধ তাদের থাকে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, দেশে সংঘটিত নানা ধরনের হত্যাকাণ্ড ও অপরাধের বীভত্সতা বিশ্লেষণ করলে লক্ষণীয় যে, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও মাদকাসক্ত অবস্থায় অপরাধ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। অপরাধীদের অপরাধ করার সময় কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, ব্যক্তিকে হত্যা করে টুকরা টুকরা করে তা নিয়ে উল্লাসও করছে। মাদক প্রতিরোধে রাষ্ট্রের জিরো টলারেন্স ঘোষণা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অফলাইন কিংবা অনলাইন-সব লাইনে মাদকের সরগরম উপস্থিতি দৃশ্যমান। মাদককে কেন্দ্র করে এক বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে, যা অত্যন্ত ভয়ের ও আতঙ্কের। মাদকসক্ত ব্যক্তি নিজের পরিবারের ও রাষ্ট্রের জন্য এক দীর্ঘমেয়াদি অভিশাপ। মাদক নির্মূল করা ছাড়া এই অভিশাপ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করেন।
মনোরোগ চিকিত্সকদের মতে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বড় অংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। মাদকের এই ভয়াবহ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে দেশ পরিচালনাসহ সব পেশায় যোগ্য ও মেধাবী লোকের তীব্র সংকট দেখা দেবে। সর্বনাশা মাদককে রুখতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সব পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। পাশাপাশি মাদক ব্যবসায়ী ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞগণ।
দেশের অন্যতম মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, ‘মাদকাসক্তদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যা সর্বাধিক। এছাড়া প্রায় সব পেশার লোকজন কমবেশি মাদকাসক্ত হয়ে তার কাছে চিকিত্সা নিতে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলগামী ছাত্রদের মধ্যে ইয়াবা আসক্ত কম নয়। এসব কারণে অপরাধ বেড়ে চলছে। টুকরা টুকরা করে হত্যা করলেও খুনিদের ভেতরে কোনো অনুশোচনা দেখতে পাওয়া যায় না।’
জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে মাদক পাওয়া যাবে না। বিশেষ করে ইয়াবা। প্রতিটি গ্রামে প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনা চলছে। মোটর সাইকেলযোগে গ্রামের পর গ্রাম সরবরাহ করছে একদল তরুণ। বাড়ছে গ্রামাঞ্চলে হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এর সত্যতা স্বীকার করা হয়েছে। মাদক ব্যবসার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের একটা অংশ জড়িত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও একটি অংশ মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা এর সত্যতা স্বীকার করে বলেছেন, দেশে খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে মাদক।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা আসছে প্রচুর। তরুণ-কিশোররাই বেশি ইয়াবা আসক্ত হচ্ছে। অপরাধ ও নৃশংসতা বৃদ্ধির এটা অন্যতম কারণ। এই কর্মকর্তার মতে,অভ্যন্তরীণ অভিযানে কে বেশি মামলা করবে এই নিয়ে যেন প্রতিযোগিতা চলে। অনেকে প্রশংসা পাচ্ছেন। ঐ কর্মকর্তার মতে, প্রতিদিন যে পরিমাণ মাদক আসছে উদ্ধার হচ্ছে খুবই কম, যা মহাসমুদ্রের এক ফোঁটা পানির মতো। কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া মাদক নির্মূল সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে র্যাবের মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি এ কে এম শহিদুর রহমান বলেন, মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধে গত এক সপ্তাহে ৬০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মাদক ব্যবসায়, খুন, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িতদের তালিকা অনুযায়ী গ্রেফতারে দেশব্যাপী র্যাবের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।