প্রকাশিত: অক্টোবর ৭, ২০২৫
ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করতে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরামর্শ চিকিৎসকদের।
বিশেষ প্রতিনিধি ঃ
ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার খরচ মেটানোর ব্যাপারটি কমবেশি সবার জানা। ক্যানসারের মতো জটিল রোগের চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে অনেক পরিবার তাদের সঞ্চিত অর্থ শেষ করে, সম্পত্তি বিক্রি করে, ঋণ করতে বাধ্য হয়। এভাবে অনেক পরিবারকেই নিঃস্ব হতে হয়। তার পরও দেরিতে রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা শুরু হওয়ার ফলে অনেক রোগীর মৃত্যুবরন করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর তথ্যমতে, বেসরকারি হাসপাতালে ক্যানসার চিকিৎসায় উচ্চ ব্যয়ের প্রধান খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, সার্জারি, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ফি এবং হাসপাতালে দীর্ঘ সময় থাকার খরচ। অন্যদিকে, সরকারি পর্যায়ে বিনা মূল্যে বা স্বল্প খরচে ক্যানসার চিকিৎসার সুযোগ খুবই সীমিত। বেসরকারি হাসপাতালে উচ্চ খরচের কারণে অনেক পরিবার দেশের বাইরে যাওয়ার কথা চিন্তা করে। সেখানে সব মিলিয়ে খরচ আরও বেশি।
বাংলাদেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসার শনাক্ত হয় রোগের তৃতীয় বা চতুর্থ পর্যায়ে। যে কারণে রোগীদের সুস্থ হওয়ার হারও কম হয়। অন্য ক্যানসারগুলোর ক্ষেত্রেও শনাক্ত হওয়ার পর্যায় একই রকম হয়ে থাকে। খুব কম ক্ষেত্রেই একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্ত হয়। এর বড় কারণ অসচেতনতা ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করানোর প্রবণতা।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে ক্যানসারে আক্রান্ত একজন রোগীর চিকিৎসায় গড়ে ৫ লাখ ৪৭ হাজার ৮৪০ টাকা খরচ হয়। এই খরচ সর্বনিম্ন ৮১ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় ওষুধপত্রের জন্য। ক্যানসারের প্রথম স্তরে গড়ে চিকিৎসা খরচ প্রায় ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা। দ্বিতীয় স্তরে এই খরচ বেড়ে প্রায় ৭ লাখ টাকায় পৌঁছায়। এই ব্যয় মেটাতে প্রায় ৭৮ শতাংশ পরিবারকে ঋণ করতে হয়। ৬৫ শতাংশ পরিবার নিয়মিত আয় থেকে খরচ বহন করে। ৫৬ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় ভাঙে। ৪০ শতাংশ পরিবার সম্পদ বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
ব্যয়বহুল চিকিৎসার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সরকারি হাসপাতালের খরচ মধ্যবিত্তের নাগালে থাকলেও সেখানে চিকিৎসা পেতে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকতে হয়। ফলে অনেকের চিকিৎসায় ভাটা পড়ে। নিম্নবিত্ত অনেক পরিবার উপায়ন্তর না দেখে চিকিৎসাই বন্ধ করে দেন। এছাড়া আমাদের দেশে নাগরিকদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য বিমাও নেই। দাতব্য কর্মসূচিও তেমন নেই। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় দরিদ্র রোগীদের ৫০ হাজার টাকা দিয়ে থাকে। সাধারণ স্বাস্থ্য বিমা ও দাতব্য সহায়তা থাকলে ক্যান্সার চিকিৎসার উচ্চ খরচের ধকল কিছুটা হলেও সামাল দেওয়া সম্ভব হতো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্যান্সার প্রতিরোধেও সবাইকে জোর দিতে হবে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি, যাতে প্রাথমিক পর্যায়েই রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হয়। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ, সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন খান আমাদের সংবাদদাতাকে বলেন, হাসপাতালে মজুত থাকলে রোগীদের বিনা মূল্যে ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী ওষুধের সরবরাহ থাকে না। ফলে রোগীদের ওষুধ নিজেদের খরচে বাইরে থেকে কিনতেই হয়। এছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেয়, বেসরকারি সংস্থা ‘আস্থা’ সহায়তা দেয়। আকিজ গ্রুপও রোগীদের ৩০ হাজার টাকা করে দেয়।
একই হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মো. ওয়ারেছ মারুফ রহমান আমাদের সংবাদদাতাকে বলেন, ক্যান্সারের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সরকারের একার পক্ষে এই ব্যয় বহন করা সম্ভব নয়। বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা, এনজিও এগিয়ে এলে হয়তো নিম্ন আয়ের মানুষগুলো চিকিৎসা পেতে পারত। এছাড়া চিকিৎসা বিমা থাকা জরুরি ছিল।
তিনি বলেন, ‘ক্যান্সারের কিছু অত্যাধুনিক চিকিৎসা আছে, যেমন—ইমিউনোথেরাপি, যা ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে দেহের রোগপ্রতিরোধ-ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে তোলে। তবে এই চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। আমাদের এখানে আসা রোগীদের মধ্যে ১০০ জনের মধ্যে ২/৩ জন এই চিকিৎসা নিতে পারেন। রেডিও থেরাপির উন্নত মেশিন বের হয়েছে, যা শুধু ক্যান্সার আক্রান্ত কোষকে মেরে ফেলে। ভালো কোষগুলোকে জীবিত রাখে। সেই মেশিন অনেক দামি, সেটি ব্যবহার করা গেলে রোগীরা উপকৃত হবেন।