১৬ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার,সকাল ৮:৫২

গাজা যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন ২১ দফায় কী আছে

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫

  • শেয়ার করুন

ডেক্স ঃ

গাজা যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবের শুরুটা হবে সেখানে সব ধরনের সামরিক অভিযান তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধের মাধ্যমে। যেখানে যে অবস্থায় আছে যুদ্ধ সেখানে থেমে যাবে। যুদ্ধবিরতি কার্যকরের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জীবিত ২০ ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে। এর পাশাপাশি ২৪ জিম্মির মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।

গাজায় যুদ্ধ বন্ধে এ রকম ২১ দফার একটি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে ট্রাম্প প্রশাসন। ওই পরিকল্পনার একটি অনুলিপি দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পেয়েছে। এ ছাড়া এ দুই দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা এটি যাচাই করা হয়েছে। ওই দুই দেশের প্রশাসনের কাছ থেকে তাঁরা এ বিষয়ে ব্রিফ পেয়েছেন। তাঁদের তথ্য অনুযায়ী, হামাসের যাবতীয় আক্রমণাত্মক অস্ত্র ধ্বংস করা হবে। যাঁরা ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে প্রতিশ্রুতি দেবেন তাঁদের ক্ষমা করে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর হামাসের যেসব সদস্য  গাজা ছাড়তে চান, তাঁদের নিরাপদে অন্য দেশে যেতে সহায়তা করা হবে।

ইসরায়েল বা হামাস দু’পক্ষের কেউ এখনো এই তিন পৃষ্ঠার প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় সম্মত হয়নি। মার্কিন কর্মকর্তারা গত সপ্তাহে জাতিসংঘে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে আঞ্চলিক ও মিত্র দেশগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে এটা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আজ সোমবার হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের সময় প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে তাঁকে চাপ দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গত শুক্রবার ইসরায়েলের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর বৈঠকের আগেই তাঁর দেশের নেতৃবৃন্দ পরিকল্পনাটি পর্যালোচনা করে দেখবেন।

হামাসের কর্মকর্তারা বলেছেন, তাদের এখনো পরিকল্পনাটির কোনো অনুলিপি দেওয়া হয়নি।

পরিকল্পনায় উল্লিখিত শাসন, নিরাপত্তা, পুনর্বাসন এবং উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়গুলো এরই মধ্যে কার্যকর করা হয়েছে কি না, কিংবা যদি সত্যিই অবিলম্বে অস্ত্রবিরতি সম্ভব হয়, সেগুলো কত দ্রুত বাস্তবায়ন করা যেতে পারে, তা অস্পষ্ট রয়ে গেছে।

ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার সময় গাজা যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে বারবার দাবি করেছেন, আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে শিগগিরই গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। গত শুক্রবারও তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, আমরা হয়তো গাজা নিয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছি। আমরা খুব কাছে আছি। আমি মনে করি এটি এমন একটি চুক্তি হতে যাচ্ছে, যা জিম্মিদের ফেরত দেবে। এটি এমন একটি চুক্তি হতে যাচ্ছে, যা যুদ্ধ শেষ করবে।’

ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবে ২১ দফা কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা নিয়ে খুব কম কথা বলা হয়েছে বা বিস্তারিত কোনো তথ্য নেই। শুধুমাত্র প্রাথমিক অস্ত্রবিরতি, জিম্মিদের মুক্তি এবং মানবিক সহায়তা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ আছে। তবে এতে সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে, গাজাবাসীকে চলে যেতে বাধ্য করা হবে না এবং যারা (গাজা) ছেড়ে যাবে তাঁরা ফেরত আসার অধিকার রাখবে। কিন্তু উপত্যকাটির ‘পুনর্গঠন বা ট্রাম্পের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা’ চলাকালে তাঁরা কোথায় যাবেন, তা প্রস্তাবে বলা হয়নি।

কূটনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর এ বিষয়টি নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গাজার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রস্তাবটির কিছুই চূড়ান্ত নয়। এসব কেবল সাধারণ রূপরেখা। এখনো কিছু বিষয় সমাধান করা বাকি।’

প্রস্তাবটির বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে হোয়াইট হাউস তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়নি। গত শনিবার টাইমস অব ইসরায়েলের এক প্রতিবেদনে পরিকল্পনার কিছু অংশ প্রকাশ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা প্রস্তাবের কিছু অংশ খুব নির্দিষ্ট। এতে বলা রয়েছে, ‘সব ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার পর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ২৫০ ফিলিস্তিনিকে ছেড়ে দেবে ইসরায়েল। পাশাপাশি ৭ অক্টোবরের পর আটক ১ হাজার ৭০০ গাজাবাসীকেও ছেড়ে দেওয়া হবে। এ ছাড়া ইসরায়েলি জিম্মিদের প্রতি মরদেহ ফেরত দেওয়ার বিনিময়ে ১৫ জন করে গাজাবাসীর মরদেহ ফেরত দেবে ইসরায়েল।’

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘এই চুক্তি গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে গাজা উপত্যকায় কালবিলম্ব না করে পূর্ণমাত্রায় সহায়তা পাঠানো হবে। এর মধ্যে রয়েছে অবকাঠামো (পানি, বিদ্যুৎ, নর্দমা) পুনর্গঠন, হাসপাতাল ও বেকারি পুনর্গঠন এবং ধ্বংসস্তূপ সরাতে ও রাস্তা খোলার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের পাঠানো হবে।’ কিন্তু কারা এসব কাজ করবে বা অর্থ দেবে, তা পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়নি।

গাজায় ত্রাণ সহায়তা প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করায় বিশ্বের অনেক দেশ ইসরায়েলের সমালোচনা করেছে। অন্যদিকে জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থার বিরুদ্ধে অক্ষমতা এবং হামাসের প্রতি সহমর্মিতা দেখানোর অভিযোগ এনেছে ইসরায়েল। তা ছাড়া হামাসের বিরুদ্ধে ত্রাণ চুরি করে সন্ত্রাসবাদকে অর্থায়নেরও অভিযোগ এনেছে দেশটি।

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘ত্রাণ প্রবেশ ও বিতরণ। দুই পক্ষের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই জাতিসংঘ ও তার সংস্থাগুলোর মাধ্যমে করা হবে। পাশাপাশি অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানও (এর সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবে) যেগুলো দুই পক্ষের সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত নয়।’ কিন্তু এতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন অন্তর্ভুক্ত আছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। সংস্থাটি বর্তমানে দক্ষিণ গাজায় ত্রাণ বিতরণ করেছে।

পরিকল্পনায় ‘যোগ্য ফিলিস্তিনি এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের’ দ্বারা তৈরি ‘অস্থায়ী অন্তর্বর্তী শাসনের’ কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা গাজার ‘দৈনন্দিন’ জনসেবা পরিচালনা করবে। অন্যান্যের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একটি ‘নতুন আন্তর্জাতিক সংস্থা’ গাজা অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘সমর্থন ও তত্ত্বাবধান’ করবে। একই সময়ে পশ্চিম তীরভিত্তিক ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ অভ্যন্তরীণ সংস্কার বাস্তবায়ন করবে। এই সংস্কার তত দিন পর্যন্ত চলবে যত দিন তারা গাজা পরিচালনার ভার নেওয়ার মতো সক্ষম বলে বিবেচিত হয়।

ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে,  ‘একটি অস্থায়ী আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা রক্ষাকারী বাহিনী (স্টাবিলাইজেশন ফোর্স) গঠনের জন্য আরব এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করবে যুক্তরাষ্ট্র , যা অবিলম্বে গাজায় মোতায়েন করা হবে এবং নিরাপত্তা তদারকি করবে।’ এই বাহিনী ততক্ষণ পর্যন্ত কাজ করবে যতক্ষণ একটি ফিলিস্তিনি বাহিনীকে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে।

নথিতে এটাও বলা হয়েছে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী ‘গাজার যেসব অঞ্চল দখল করছে, তা ধাপে ধাপে তারা যে হস্তান্তর করবে।’ শেষ পর্যন্ত শুধু ‘সীমান্ত উপস্থিতি’ ছাড়া ইসরায়েলের সেনাদের গাজা থেকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করা হবে।

গাজার এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কিছু আরব সরকার প্রাথমিকভাবে আন্তর্জাতিক বাহিনীতে অংশগ্রহণে সম্মত হয়েছে, তবে এ বিষয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন।
এদিকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ট্রাম্প নেতানিয়াহুর প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠেছেন এবং কাতারে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বিমান হামলায় প্রকাশ্যে অসন্তোষ জানিয়েছেন।

দোহায় ওই হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিলেন হামাসের আলোচকেরা । তাঁরা ট্রাম্পের দূত স্টিভ উইটকফের একটি প্রস্তাব বিবেচনা করছিলেন। ওই পরিকল্পনা নিয়ে গত আগস্টের শেষ দিকে হোয়াইট হাউসে বৈঠক করেন ট্রাম্প। যেখানে উপস্থিত ছিলেন ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্য নীতির নেতৃত্ব দেওয়া জ্যারেড কুশনার ও যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার।

বর্তমান পরিকল্পনায় আগের পরিকল্পনার অনেকটাই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তবে এতে নতুন কিছু উপাদান নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে। নতুন করে যুক্ত হয়েছে গাজা দখল বা গাজার কোনো অংশ ইসরায়েল দখল করবে না তার প্রতিশ্রুতি ও কাতারে আর কোনো হামলা চালাবে না সে বিষয়টিও।

পরিকল্পনায় এই সংঘাতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাতারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে । এতে উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলই প্রথম হামাস আলোচকদের আতিথ্য দিতে কাতারকে অনুরোধ করেছিল।

কাতার হামলা নিয়ে অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েলের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, হামাস নেতাদের হত্যা করায় আরব নেতারা গোপনে খুশি। তবে আরব নেতারা চান না সেটা তাদের ভূখণ্ডে সংগঠিত হোক।

  • শেয়ার করুন